সোম, ১০ অক্টোবর ২০১১, ২৫ আশ্বিন ১৪১৮
চলতি বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ছেড়ে চলে গেছেন। পুঁজিবাজারে বিপর্যয়ের পর বিনিয়োগে নিরুত্সাহিত হওয়ায় এসব বিনিয়োগকারী তাদের বিও হিসাব নবায়ন করেননি। বছরের শুরুতে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশ লিমিটেডে (সিডিবিএল) বিও হিসাবের সংখ্যা ৩৪ লাখ ছাড়িয়ে গেলেও বর্তমানে সক্রিয় হিসাবের সংখ্যা ২৭ লাখ ৬৯ হাজারে দাঁড়িয়েছে।
বিও হিসাব নবায়ন না করা বিনিয়োগকারীদের অধিকাংশই প্রাথমিক শেয়ার পাওয়ার জন্য প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) আবেদন করতেন। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে নতুন কোনো আইপিও না আসায় এসব বিনিয়োগকারী উত্সাহ হারিয়ে ফেলেন। অনেক বিনিয়োগকারী লটারিতে শেয়ার পাওয়ার জন্য ১০-১৫টি বিও হিসাব পরিচালনা করতেন। বাজার চাঙ্গা থাকা অনেক আবেদন করে লটারিতে দু’এক লট শেয়ার পেলেও ভালো মুনাফা করা যেত। নতুন আইপিও না থাকায় তাদের বিও হিসাবগুলো কাজে লাগছে না। তাছাড়া মবিল যমুনা লুব্রিক্যান্ট ও এমআই সিমেন্টের প্রাথমিক শেয়ার পাওয়ার পর বিনিয়োগকারীদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাতে অনেকে আইপিওর প্রতিও উত্সাহ হারিয়েছেন। বিপুলসংখ্যক বিও হিসাব নবায়ন না হওয়ার এগুলোই মূল কারণ।
সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরুতে দেশে বিও হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৪ লাখ। এরমধ্যে মাত্র ১১ লাখ বিও হিসাবের মাধ্যমে নিয়মিত শেয়ার লেনদেন করা হয়েছে। ১৩ লাখ বিও হিসাবে কখনও কোনো শেয়ার ছিল না। এসব বিও হিসাব শুধু প্রাথমিক শেয়ারে আবেদনের জন্য ব্যবহূত হয়। আইপিও আবেদনের পর প্রতিবারই লটারিতে ব্যর্থ হওয়ায় হিসাবগুলোতে কখনও কোনো শেয়ার জমা হয়নি।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ২০০৯-১০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বিনিয়োগ অনুকূল বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় দেশের পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। ওই সময় বিদ্যুত্ ও গ্যাস সংকটের কারণে উত্পাদনশীল খাতে বিনিয়োগে মন্দা বিরাজ করায় শেয়ারবাজারে অর্থপ্রবাহ ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। গত বছর বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমিয়ে দেওয়ায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকে। ওই সময় প্রতি দিনই বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন বিও হিসাব খুলে শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকেন।
বিনিয়োগকারী এবং অর্থপ্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভালো শেয়ারের জোগান বৃদ্ধিতে ব্যর্থতা এবং সুযোগসন্ধানীদের কারসাজির ফলে বাজারে অধিকাংশ শেয়ারের দর অতি মূল্যায়িত হয়ে পড়ে। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে গত ডিসেম্বরে বাজারে বড় ধরনের ধস নামে। বাজারে তারল্য সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় একের পর এক বিপর্যয়ে লোকসানের মুখে পড়েন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। এতে শেয়ারবাজার সম্পর্কে নতুন বিনিয়োগকারীদের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়। এ কারণে অনেকেই লোকসান দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বেরিয়ে যান। এদের অনেকেই এবার বিও হিসাব নবায়ন করেননি।
সিডিবিএল সূত্রে প্রাপ্ত হিসাবে দেখা গেছে, গত মার্চ মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের আওতাধাীন ব্রোকারেজ হাউসগুলোর আওতায় মোট ৩৪ লাখ বিও হিসাব চালু ছিল। ওই সময় বিও হিসাবধারী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ২৫ লাখ ৫ হাজার ৭০২ জন পুরুষ এবং ৮ লাখ ৭৯ হাজার ২১২ জন নারী ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বাকি ৮ হাজার ৬৩৩টি হিসাব খোলা হয়েছিল।
মার্চ মাস থেকে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসে নবায়ন শুরু হলে বিও হিসাবের সংখ্যা ক্রমেই কমতে থাকে। ৩০ জুন নবায়নের নির্ধারিত সময় শেষে মোট বিও হিসাবের সংখ্যা ৩১ লাখ ৯ হাজার ৭১৭টিতে দাঁড়ায়। নবায়ন প্রক্রিয়ার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ লাখ ৬০ হাজারে। সর্বশেষ গত সপ্তাহ পর্যন্ত এ সংখ্যা ২৭ লাখ ৬৯ হাজার ১০৯-এ দাঁড়িয়েছে। হিসাব পরিচালনাকারীদের মধ্যে ২০ লাখ ৫২ হাজার ২২৭ জন পুরুষ এবং ৭ লাখ ৮ হাজার ৪৯২ জন নারী। বাকি বিও হিসাবগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে পরিচালিত।
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে চাইলে সিডিবিএলের আওতাধীন যে কোনো ডিপিতে (ডিপোজিটরি পার্টিসিপেন্ট) একটি বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব খুলতে হয়। একজন ব্যক্তি একটি ব্যাংক হিসাবের বিপরীতে একক নামে একটি এবং যৌথ নামে একটি বিও হিসাব খুলেত পারেন।
সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) ডিপোজিটরি (ব্যবহারিক) প্রবিধানমালা, ২০০৩-এর তফসিল-৪ অনুযায়ী, বিও হিসাব পরিচালনার জন্য ডিপজিটরি অংশগ্রহণকারী বা বিনিয়োগকারীকে নির্ধারিত হারে বার্ষিক হিসাব রক্ষণ ফি প্রদান করে হিসাব নবায়ন করতে হয়। এর আগে পঞ্জিকা বর্ষ হিসাবে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে এই ফি অগ্রিম নেওয়া হতো। তবে গত বছর এসইসি বিও হিসাব নবায়নের সময় পরিবর্তন করে জুন মাস নির্ধারণ করে দেয়। সে অনুযায়ী গত ৩০ জুন ছিল ২০১১-১২ অর্থবছরের জন্য বিও হিসাব নবায়নের শেষ সময়। প্রতিটি বিও হিসাব নবায়নের জন্য বর্তমানে ৫০০ টাকা ফি পরিশোধ করতে হয়। এরমধ্যে সিডিবিএল ১৫০ টাকা, হিসাব পরিচালনাকারী ব্রোকারেজ হাউস ১০০ টাকা এবং এসইসি ৫০ টাকা পায়। বাকি ২০০ টাকা সরাসরি সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়।
সিডিবিএল সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে পুঁজিবাজারে সক্রিয় বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৮৫ হাজার ১৪৪টি। ২০০৮ সালে তা ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৩৩৪টিতে দাঁড়ায়। ২০০৯ সালের শেষ দিকে এসে বিও হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। নির্ধারিত সময়ে নবায়ন না করায় বিপুল পরিমাণ বিও নিষ্ক্রিয় বিও হিসাব বাতিল করার পর ২০০৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিও হিসাবের সংখ্যা ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৫০০টিতে দাঁড়ায়। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের আওতায় বিও হিসাবধারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪৬৭। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন না করায় গত বছর জুলাই মাসে প্রায় ১ লাখ এবং অক্টোবরে প্রায় ৩০ হাজার বিও হিসাব বাতিল করা হয়। তা সত্ত্বেও ৩১ ডিসেম্বর বিও হিসাবধারী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ৩২ লাখ ৭৯ হাজার ১৫৮ জনে দাঁড়ায়। সেই হিসাবে এক বছরে পুঁজিবাজারে নতুন প্রায় ১৯ লাখ ৪২ হাজার বিনিয়োগকারী যুক্ত হন। সাম্প্রতিক বিপর্যয়ে বড় ধরনের লোকসান দেওয়ার পর অনেক বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজার ছেড়ে চলে যান। এসব বিনিয়োগকারীই নির্ধারিত সময়ে নবায়ন ফি জমা দেননি।
No comments:
Post a Comment